মোঃ আল-মুকিদ মাহি, জেলা প্রতিনিধি ঠাকুরগাঁও।

রাণীশংকৈল উপজেলা বাংলাদেশের একটি প্রশাসনিক এলাকা যা রংপুর বিভাগের ঠাকুরগাঁও জেলার অন্তর্ভূক্ত। ৩৩৭.৮০ বর্গ কিমি আয়তনের এই উপজেলাটির উত্তরে বালিয়াডাঙ্গী ও ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা; দক্ষিণে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য; পূর্বে পীরগঞ্জ ও ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা এবং পশ্চিমে হরিপুর উপজেলা অবস্থিত।

রাণীশংকৈল উপজেলার পটভূমিঃ– অনেক বছর আগের কথা। এই ঠাকুরগাঁও জেলা শহরে তখন জনপদ গড়ে উঠেনি। বহতা টাংগন নদীর দু’পাশ জুড়ে ছিল বিশাল শালবন। সবুজ অরণ্য ঘেরা এই এলাকার নাম ছিল শালবাড়ি পরগণা। উনিশশত খৃস্টাব্দের প্রথম দিকে এর জনপদটি ছিল মালদুয়ার পরগণার অন্তর্গত। পরে জমিদার বুদ্ধিনাথের ছেলে টংকনাথ বৃটিশি সরকারের আস্থা লাভ করতে ‘মালদুয়ার স্টেট’গঠন করেন। কথিত আছে টাকার নোট পুড়িয়ে জনৈক বৃটিশ রাজকর্মচারীকে চা বানিয়ে খাইয়ে টংকনাথ ‘চৌধুরী’উপাধি লাভ করেন। এরপর দিনাজপুরের মহারাজা গিরিজানাথ রায়ের বশ্যতা স্বীকার করে ‘রাজা’উপাধি পান। রাজা টংকনাথ চৌধুরীর স্ত্রীর নাম জয়রমা শঙ্করী দেবী। ‘রানীশংকরী দেবী’র নামানুসারে মালদুয়ার স্টেট হয়ে যায় ‘রাণীশংকৈল’। মালদুয়ারের আগে এ অঞ্চল ছিল ভাতুরিয়া পরগণার অন্তর্গত। ১৮৯৩ সালে এখানে থানা প্রতিষ্ঠিত হয়। এই থানা ১৯৮৩ সালে উপজেলায় রূপ লাভ করে। বর্তমানে রাণীশংকৈল উপজেলায় ১টি পৌরসভা, ৮টি ইউনিয়ন এবং ১২৪টি মৌজা রয়েছে।

এই উপজেলায় ৮টি ইউনিয়ন রয়েছে। যথাঃ ১ নং ধর্মগড়, ২ নং নেকমরদ, ৩ নং হোসেনগাঁও, ৪ নং লেহেম্বা, ৫ নং বাচোর, ৬ নং কাশিপুর, ৭ নং রাতোর ও ৮ নং নন্দুয়ার।

দর্শনীয় স্থান  স্থাপনাঃ- রাজা টংকনাথের রাজবাড়ী – মালদুয়ার; রাজা বীরেন্দ্রনাথের রাজবাড়ী – জগদল; পীর শাহ নাসিরউদ্দীন-এর মাজার – নেকমরদ; গোরক্ষনাথ মন্দির; বাংলা গড়; রাণী সাগর – রামরাই; শিব দীঘি – গৌরকৈ; খুনিয়া দিঘি স্মৃতি সৌধ ও বধ্যভূমি; শালবাগান; হেলিপ্যাড মাঠ এবং উপজেলা মডেল মসজিদ; উপজেলা পুকুর চত্বর; মহলবাড়ি মসজিদ; রাণীশংকৈল পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় (১৯১৪); রানীশংকৈল মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় (১৯৩৬)।

ভাষাঃ- ভাষা ভিক্তিক আঞ্চলিকতার ক্ষেত্রে আর্য ও দ্রাবিড় উভয় ধরণের প্রভাব এ অঞ্চলে পরিলক্ষিত হয়। বাংলা ভাষার প্রাচীনতম নিদর্শন চর্যাপদ এর ভাষার সাথে এ অঞ্চলের ভাষার সাথে যথেষ্ট মিল আছে। এমনকি বড়ু চন্ডীদাশের শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন বিশ্লেষনে দেখা যায় গ্রন্থে ব্যবহৃত অনেক শব্দ এ অঞ্চলের মূখের ভাষা। যেমন- বুঢ়া, ঘষি, বেশোয়ার প্রভৃতি। এ অঞ্চলের জনগন মিশ্রিত আঞ্চলিক কথ্য ভাষায় কথা বললেও এখানকার আদিবাসীসমপ্রদায় পারিবারিক পর্যায়ে সাওতাল ভাষায় কথা বলে।

শিক্ষা  সংস্কৃতিঃ- প্রাচীনকালে সাধারণের মধ্যে শিক্ষার তেমন কোন প্রচলন ছিলনা। তবে গ্রাম্য বর্মনদের মধ্যে বেদ উপনিষদ কেন্দ্রিক শিক্ষার প্রচলন ছিল। ব্রিটিশ অব্যবহিত পূর্বকালে ঠাকুরগাঁও অঞ্চলে গৃহ কেন্দ্রিক টোল মক্তবের মাধ্যমে শিক্ষার প্রচলন ছিল। মূলত ব্রিটিশ শাসন আমলে এ এলাকার শিক্ষার প্রসার শূরু হয়।

বর্তমানে রাণীশংকৈল উপজেলায় শিক্ষার হারঃ- পুরুষ=৫০.২%, মহিলা=৪২.৯%, মোট=৪৬.৬%।

সংস্কৃতিঃ- রাণীশংকৈল উপজেলার নেকমরদের গোরকই নামক স্থানে আবিস্কৃত হয়েছে চর্যাপদের অন্যতম পদকর্তা নাথ সমপ্রদায়ভুক্ত বৌদ্ধসহ জিয়া সমপ্রদায়ের গুরু ধর্মগরু গোরক্ষ নাথের মন্দির, তার আমলের পাথরের তৈরী কুয়া ও একটি শিল্পলিপি। এতে প্রমাণ হয় এ অঞ্চলের সংস্কৃতি অতি প্রাচীন।

খেলাধূলা  বিনোদনঃ- আদীকাল থেকে এই উপজেলা ক্রিড়া ও সংস্কৃতির চরণ ভুমি বলেই পরিচিত এই উপজেলার ছাত্রসমাজ থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে খেলাধূলার প্রতি অসীম আগ্রহ রয়েছে। এখানে স্থানীয় প্রশাসনও খেলাধূলার বিস্তৃতি ঘটাতে সব সময় সচেষ্ট। ফলে বিভিন্ন সময় আন্তঃ উপজেলা টুনামেন্ট অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। ফলে এ উপজেলার বিশেষ করে ছাত্র সমাজ খেলাধূলার প্রতি আগ্রহ পায়, যা একটি সুস্থ্য জাতি গঠনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে। বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকার মত এ উপজেলার অদিবাসীগণ খেলা প্রিয়। ফুটবল, ক্রিকেট, ভলিবল, কাবাডি, ব্যাডমিন্টন সহ বিভিন্ন ধরনের খেলাধূলায় এখানকার মাঠগুলো সবসময় মুখরিত থাকে।

খেলাধূলাঃ- হাডুডু,ফুটবল,ক্রিকেট,ক্যারাম,ডাবা,লুডু খেলা এই উপজেলার মানুষের কাছে বেশি প্রিয়।বিনোদনঃ যাত্রা ও গ্রাম্য বিনোদনের মাধ্যম।

ভৌগলিক পরিচিতিঃ- ঠাকুরগাঁও জেলার পশ্চিম-দক্ষিণে রাণীশংকৈল উপজেলা। এর আয়তন ২৮৭.৭৪ বর্গকিলোমিটার। লোকসংখ্যাঃ ১,৯৭,৭২০ জন। (পুরুষ- ১,০২,২৪০ জন, মহিলা- ৯৫,৪৮০ জন)

নদ-নদীঃ- রাণীশংকৈল উপজেলায় মোট ৩(তিন)টি নদী আছে- (১) কুলিক নদী (২) নাগর নদী (৩) তীরনই নদী

কুলিক নদীঃ- কুলিক নদী নাগর নদীর উপ-নদী। এ নদীর শ্রোত ধারা বালিয়াডাঙ্গী, রাণীশংকৈল, হরিপুর উপজেলার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

নাগর নদীঃ- নাগর নদী ভারত হতে উৎপন্ন হয়ে পঞ্চগড় জেলা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। পঞ্চগড়ের আটোয়ারী উপজেলা থেকে বালিয়াডাঙ্গী হয়ে রাণীশংকৈলে প্রবেশ করেছে। রাণীশংকৈলের পশ্চিম অঞ্চল দিয়ে প্রবাহিত হয়ে হরিপুর উপজেলা হয়ে পূণরায় ভারতে প্রবেশ করেছে।

তীরনই নদীঃ- নাগর নদীর আরেকটি শাখা নদী হচ্ছে তীরনই নদী। নদীটি বালিয়াডাঙ্গীর উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এ নদীর উৎস্য হতে ৪২ কিঃমিঃ দূরে গিয়ে নাগর নদীর সাথে মিলিত হয়েছে।

রাণীশংকৈল উপজেলার খাল ও জলা ভূমিঃ- লেহেম্বা বিল, পামোল বিল, কাশিপুর বিল, বুড়া বিল, গড়গড়িয়া বিল।

ব্যবসা বাণিজ্যঃ- রাণীশংকৈল উপজেলার অর্থনৈতিক কর্মকান্ড মূলত, কৃষিজ পণ্য ও কৃষি কাজের উপর নির্ভরশীল। ইতোমধ্যে এ উপজেলার গম, আলু, ফুলকপি, মুলা, পটল, বেগুন, আম ও লিচু সারাদেশে বেশ পরিচিতি লাভ করেছে। মূলতঃ এ উপজেলার অর্থনৈতিক কর্মকান্ড এই কৃষিজ পণ্যকে ঘিরেই আবর্তিত হয়। এখানকার উল্লেখযোগ্য ব্যবসা কেন্দ্র হিসেবে নিম্নলিখিত বাজার গুলো উল্লেখযোগ্য।১। নেকমরদ বাজার, ২। বন্দর বাজার, ৩। শিবদিঘী বাজার, ৪। আলশিয়া হাট, ৫। কাতিহার হাট, ৬। ভরনিয়া বাজার, ৭। রাউতনগর বাজার, ৮। বলিদ্বারা বাজার, ৯। গোগর বাজার, ১০। রামপুর বাজার।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *