নয়ন দাস,কুড়িগ্রাম জেলা প্রতিনিধিঃ

ঝুপড়িঘরের সামনে সন্তানদের সঙ্গে ফুলোরানি।গৃহহীন মহানন্দের পরিবার আশ্রয় নিয়েছিল।কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার হাতিয়া ইউনিয়নের চর বাগুয়ার সরকারি আবাসন প্রকল্পে। না, সরকারি ঘর পায়নি তারা। সব আবাসন প্রকল্পের নকশায় কিছু ফাঁকা জায়গা থাকে। সেখানেই চালাঘর তৈরি করে আশ্রয় নিয়েছিল পরিবারটি।

১২ হাত চালাঘরে ১০ জনের একটি পরিবার ঠাসাঠাসি করে থাকে। মুসলিম সমাজে আশ্রয় নেওয়া পরিবারটি রবিদাস সম্প্রদায়ের হওয়ায় প্রতিবেশীদের একধরনের বাঁকা চোখ তো ছিলই। সেই সঙ্গে ছিল সরকারি সুবিধাভোগী না হওয়ায় যেকোনো সময় উচ্ছেদের চিন্তা।

শুরুতেই মহানন্দের আট সন্তানের ব্যাখ্যা দেওয়া দরকার। চার মেয়ে রেখে মহানন্দের প্রথম স্ত্রী সোহাগী মারা যান। চার সন্তানকে দেখাশোনা করবে কে? সে চিন্তা থেকে আরেকটা বিয়ের সিদ্ধান্ত নেন মহানন্দ। ফুলোরানি মহানন্দের সেই নতুন বউ। বিয়ের পর ফুলোরানির গর্ভে জন্ম নেওয়া আরও চার সন্তান—দুই ছেলে, দুই মেয়ে। সব মিলিয়ে আট সন্তান মহানন্দের।

কেন মহানন্দের আট সন্তান হলো, যেখানে তাঁর নিজেরই কর্মের ঠিক-ঠিকানা নেই–সেসব অন্য আলাপ। কুড়িগ্রামের এসব চরে জন্মনিয়ন্ত্রণের বালাই নেই। নিজে থেকে সচেতন না হলে জন্মনিয়ন্ত্রণের কোনো সহায়তা পাওয়া যায় না। দীর্ঘ সময় ধরে চরে বিভিন্ন জরিপের সূত্রে বাস্তব অভিজ্ঞতা যা দাঁড়িয়েছে তাতে চরে কোনো পরিবারেই চারজনের কম সন্তান নেই।

কোনোমতে দিন কাটছিল মহানন্দের। গ্রামের মানুষের জুতা সেলাই করে, কাজ না থাকলে এর-ওর ঘর থেকে খুঁজে এনে দিন পার করছিলেন পরিবারটির অভিভাবক মহানন্দ রবিদাস। মহানন্দ যেন দুইটি গরুর বাছুর বর্গা নেন, স্থানীয় সাবেক এক মেম্বারের তরফ থেকে এমনই এক প্রস্তাব আসে হঠাৎ করেই। এসব বর্গায় প্রাথমিক দাম নির্ধারণ করে গরু অন্য লোকের কাছে দেওয়া হয়।

ছয় মাস বা এক বছর খাওয়ানোর পর যা দাম আসে তা থেকে নির্ধারিত মূল্য আলাদা রেখে বাকিটা ভাগ করে নেওয়া হয়।মহানন্দ দেখলেন, গ্রাম ঘুরে তেমন আয় হয় না। আর বর্মিজ, প্লাস্টিক ও আর্টিফিশিয়াল চামড়ার জুতা সস্তা হওয়ায় মানুষ তেমন জুতা সেলাই করে না। এক জোড়া ছিঁড়ে গেলে নতুন আরেক জোড়া কিনে ফেলে। ফলে তেমন কাজ পাওয়া যায় না। পুরো দেশের রবিদাস সম্প্রদায়ের মধ্যে এই সংকট প্রবল।

আকাশপাতাল ভেবে মহানন্দ মেম্বারের প্রস্তাবে রাজি হয়ে যান। সহজে চরে ঘাস পাওয়াটা এই বাছুর বর্গা নিতে রাজি হওয়ার পেছনে আরেকটা বড় কারণ। প্রায় বেকার মহানন্দ নিজের সবটুকু চেষ্টা দিয়ে গরু পালন করতে শুরু করেন।

কয়েক মাস ভালোই চলল। মেম্বারের দেওয়া গরু দুটো চরের তাজা ঘাস খেয়ে বেশ তাগড়া হয়ে উঠল। কথা ছিল, কোরবানির ঈদে গরু বিক্রি করা হবে। ‘একটু’ ভালো দিনের আশায় মহানন্দের রাতে ভালো ঘুম হয়। এভাবে চলতে থাকলে মাথায় বোঝা হয়ে থাকা সোমত্ত তিন মেয়ের বিয়ে দিতে পারবেন। আর বাকি তিন মেয়ের বিয়ের সময় হতে হতে মহানন্দের সুদিন ফিরবে।

সহায়সম্বলহীন মহানন্দ জানতেন না তাঁর পরিবারের জন্য কী কঠিন দিন অপেক্ষা করছে সামনে। চৈত্রের কাঠফাটা রোদে জনমানবহীন চরে গরুর ঘাস কাটতে গিয়ে আচমকা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন মহানন্দ। কেউ বলে হার্ট অ্যাটাক, কেউ বলে সাপের কামড়!

ভিন ধর্মের এক চর্মকারের মৃত্যুরহস্য নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না তেমন। স্ত্রী ফুলোরানি আর আট সন্তান— ফুলবাবু, রাজমণি, তারামণি, বিপুল, মহারানি, আলোরানি, ময়না ও পারমণিকে অনিশ্চিত ভাগ্যের হাতে সমর্পণ করে মহানন্দ অনন্তের পথে যাত্রা করেন।

স্বামীর মৃত্যুর পর ফুলোরানির কাঁধে আট সন্তানের দায়িত্ব পড়ে। নির্দয়া ব্রহ্মপুত্রের বুকে জন্ম নেওয়া আরেকটা বুক চৌচির করে দেওয়া গল্পের নায়িকা ফুলোরানি। একদিকে ঘর নেই, আরেকদিকে কাজ নেই। এদিকে মেয়েদের বিয়ের বয়স হয়ে গেছে। বিয়ের বয়স হয়ে যাওয়া মেয়েদের নিয়ে ভাঙা চালাঘরে ঘুমহীন রাত কাটান ফুলোরানি। সকাল হলেই বেরিয়ে পড়েন একমুঠো ভাতের সংস্থানে। প্রতিবেশীর দুয়ারে হাত পেতে যা কিছু পান তাই দিয়ে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটে ফুলোরানি আর তাঁর আট সন্তানের।

কী করবেন, কী খাবেন, কী পরবেন, মেয়েদের বিয়েই বা দেবেন কীভাবে? প্রতিবেশীদের ঘরে ঘরে ভিক্ষা করে পেট চালানো যায় হয়তো, কিন্তু ছয় মেয়েকে বিয়ে দেওয়া যায় না। ফুলোরানির দায়িত্ব তাহলে নেবে কে? তাঁর একটা ঘর দরকার, মেয়েদের বিয়ে দিতে টাকা দরকার। এই দুর্গম চর বাগুয়ায় ফুলোরানির এই সংকটগুলো কে ঘোচাবে?

রাষ্ট্র বলে তারা নাকি গৃহহীনকে গৃহ দিচ্ছে! ফুলোরানির মতো অনেকেই তা পাননি। রাষ্ট্রের দেওয়া ঘর তবে পাচ্ছে কে? রাষ্ট্রের সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর আওতায় যদি ফুলোরানিরা না পড়েন তাহলে কাদের জন্য এই সুবিধা? আট সন্তানের বিধবা মা যদি ‘বিধবা ভাতা’ না পান, তবে কে পাবেন, কাদের জন্য এসব সুবিধা শুনতে বড় ইচ্ছে হয়!

সমাজের কাছে, দেশের মানুষের কাছে একটা ঘরের আকুতি জানিয়েছেন ফুলোরানি। যে ঘরে আটজন সন্তান নিয়ে একটু আশ্রয় নিতে পারবেন। যে ঘরে আশ্রয় নিলে রাতবিরেতে বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর আসবে না সন্তানদের। যে ঘরে আশ্রয় নিলে ফুলোরানির মেয়েদের নিরাপত্তা নিয়ে আর ভয় থাকবে না।

ফুলোরানির বড় মেয়ে মহারানির বিয়ে ঠিক হয়েছে। বিয়ে শেষ করতে ৫০ হাজার টাকার প্রয়োজন। বরপক্ষ সময় বেঁধে দিয়ে গেছে, এর মধ্যে সব আয়োজন করতে পারলে মহারানিকে ঘরে তুলবে, নচেৎ নয়।

দিন যত ঘনিয়ে আসছে ফুলোরানির মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ছে। এক বেলা ভাতের সংস্থান নেই যার কে দেবে তাঁকে এতগুলো টাকা? ফুলোরানি আকুতি জানিয়েছেন, যেন তাঁর দুঃখের কথা ছড়িয়ে দিই। তাঁর বিশ্বাস, কেউ না কেউ এগিয়ে আসবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *